*নিবেদিতার সমাজ-ভাবনা*
*পূর্বা সেনগুপ্ত*
*অধ্যাপিকা, গবেষণা বিভাগ , রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অব কালচার, কলকাতা।*
*মূলগ্রন্থ*
*(ভারতচেতনায় ভগিনী নিবেদিতা*
*সঙ্কলক ও সম্পাদক স্বামী চৈতন্যানন্দ)*
( ষষ্ঠ পর্ব)
সামাজিক সম্মেলন ও ভিক্ষুক: কেবল নদী নয়, বাগবাজারে বসে নিবেদিতা
আর-একটি বিষয়ের মনোজ্ঞ বিশ্লেষণ করেছেন। এই বিষয়টি হলো ‘ভিক্ষুক'।
এখানে তিনি দেখিয়েছেন, সামাজিক স্তরবিন্যাসের সর্বশেষ স্তরে যাদের উপস্থিতি
তারাই ভিখারি। এরা গৃহে গৃহে অর্থ, অন্ন এবং বস্ত্রের প্রত্যাশী হয়ে ঘুরে বেড়ায়।
কখন গান গেয়ে কখন বা শুধুমাত্র ঈশ্বরের নাম উচ্চারণ করে গৃহস্থের অঙ্গনে
কিছু জিনিস চেয়ে নেয়। এই প্রলেতারিয়েত বা সর্বহারা শ্রেণি সম্বন্ধে বলতে৩৮০
গিয়ে কার্ল মার্ক্স বলেছেন, এদের সমাজে কোনরূপ ইতিবাচক ভূমিকা থাকে না।
কিন্তু নিবেদিতা দেখিয়েছেন, ভারতে এই ভিক্ষুক বা ভিখারি সম্প্রদায়ের একটি
ইতিবাচক দিক আছে। এই শ্রেণির সঙ্গে ব্যবহারে ভারতীয় সমাজ ইউরোপের মতো
যান্ত্রিক নয়, বরং অনেক বেশি মানবিক। নিবেদিতা লিখছেন: “ভারতীয় জীবনে
ভিক্ষুকের সামাজিক তাৎপর্যের মতো আকর্ষণীয় বিষয় খুব কমই আছে। কান্ট
এবং স্পিনোজার জীবনে সম্পদের প্রতি যে বিতৃষ্ণা দেখি তা ভারতীয় পরিবেশে
সহজেই যথার্থ ত্যাগে পর্যবসিত হয়। এখানে গৃহ ও আচ্ছাদনের প্রয়োজন খুব
সামান্য—একমুঠো চাল যে-কোন বাড়িতে পাওয়া যায় এবং কিছু শাকপাতাই শুধু
দরকার। কিন্তু ভিক্ষুকের ওপরে সবাই দায়িত্ব দিয়েছে তার পৃষ্ঠপোষকদের সঙ্গে
মত-বিনিময় ও মহৎ চিন্তার। সুতরাং সে উঠানে দাঁড়িয়ে গান গেয়ে বা মন্ত্র পড়ে
নিজের উপস্থিতি জানায়। অর্থাৎ সে সর্বদা ভগবানের নাম করতে করতে আসে।
এদের গান নিয়ে গোটা সাহিত্যই আছে।... ইউরোপে আমরা যাকে বলি ‘কেল্টিক
ভাব’, এগুলো তাতে পূর্ণ। সুতরাং খুব সাধারণভাবে বলতে গেলে ভারতীয় ভিক্ষুক
স্বদেশের লোককাব্যের সংরক্ষক।... আবার যে-স্ত্রীলোক তাকে ভিক্ষা দেয়, সে তার
ধর্মশিক্ষকও। যে-সব বিষয়ে স্ত্রীলোকটি অপর কাউকে কিছু বলার সুযোগ পায় না,
সে-সব বিষয়ে ভিক্ষুক আলোচনা করে এবং এইভাবে সংস্কৃতিকে দূর-দূরান্তরে ছড়িয়ে
দেয়।” অর্থাৎ নিবেদিতার কাছে এই ভিখারি শ্রেণি ছিল চলমান সংস্কৃতির বাহক।
কিন্তু এই ভিখারিদের মধ্যেও থাকে গোঁড়ামি, তারা নিজের গণ্ডি বা জাতি সম্বন্ধে
সচেতন। নিবেদিতা উল্লেখ করেছেন, একবার একটি পাউরুটি কিনে ভিখারিকে
দিতে গেলে সেই ভিখারি তা নিতে অস্বীকার করে। কারণ, খামি দিয়ে পাউরুটি
প্রস্তুত করেছে কোন মুসলমান আর তা প্রদত্ত হচ্ছে নিবেদিতার হাত দিয়ে। সুতরাং
তা খ্রিস্টানের ছোঁয়া। বিধর্মীর স্পর্শদোষে দুষ্ট খাদ্যকে কোন ভিখারিও গ্রহণ করতে
নারাজ। তবে এ যদি রুটি না হয়ে কিছু পয়সা হতো, তবে সে আনন্দের সঙ্গে
গ্রহণ করত। এই মানসিকতা দেখে নিবেদিতা অবাক হয়েছেন। জাতিব্যবস্থার মধ্যে
বা সামাজিক স্তরবিন্যাসের মধ্যে অন্ন গ্রহণ ও প্রদানের যে-রীতিনীতি আছে তা
ধনহীন ভিক্ষুকও নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে। যদিও এই ঘটনা নিবেদিতাকে আহত
করেছিল। তাঁর ধারণা ছিল বিদেশে ভিখারিদের পয়সা দিলে তারা মদ কিনে খায়,
তাই দান হিসাবে কিছু খাদ্যদানই শ্রেয়। কিন্তু ভারতে এসে সেই ধারণা নিবেদিতার
ভেঙে যায়। বর্তমানে আমরা জাতিব্যবস্থার কাঠামোকে যেহেতু কঠোরভাবে পালন
করি না, তাই এখন অর্থের পরিবর্তে খাদ্যদানকেই উৎকৃষ্ট বলে কোন কোন ক্ষেত্রে
স্বীকার করা হয়। কিন্তু নিবেদিতার সময় পরিস্থিতি ছিল ভিন্ন।
(পৃষ্ঠা - ৩৭৯ - ৩৮০)
*পূর্বা সেনগুপ্ত*
*অধ্যাপিকা, গবেষণা বিভাগ , রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অব কালচার, কলকাতা।*
*মূলগ্রন্থ*
*(ভারতচেতনায় ভগিনী নিবেদিতা*
*সঙ্কলক ও সম্পাদক স্বামী চৈতন্যানন্দ)*
( ষষ্ঠ পর্ব)
সামাজিক সম্মেলন ও ভিক্ষুক: কেবল নদী নয়, বাগবাজারে বসে নিবেদিতা
আর-একটি বিষয়ের মনোজ্ঞ বিশ্লেষণ করেছেন। এই বিষয়টি হলো ‘ভিক্ষুক'।
এখানে তিনি দেখিয়েছেন, সামাজিক স্তরবিন্যাসের সর্বশেষ স্তরে যাদের উপস্থিতি
তারাই ভিখারি। এরা গৃহে গৃহে অর্থ, অন্ন এবং বস্ত্রের প্রত্যাশী হয়ে ঘুরে বেড়ায়।
কখন গান গেয়ে কখন বা শুধুমাত্র ঈশ্বরের নাম উচ্চারণ করে গৃহস্থের অঙ্গনে
কিছু জিনিস চেয়ে নেয়। এই প্রলেতারিয়েত বা সর্বহারা শ্রেণি সম্বন্ধে বলতে৩৮০
গিয়ে কার্ল মার্ক্স বলেছেন, এদের সমাজে কোনরূপ ইতিবাচক ভূমিকা থাকে না।
কিন্তু নিবেদিতা দেখিয়েছেন, ভারতে এই ভিক্ষুক বা ভিখারি সম্প্রদায়ের একটি
ইতিবাচক দিক আছে। এই শ্রেণির সঙ্গে ব্যবহারে ভারতীয় সমাজ ইউরোপের মতো
যান্ত্রিক নয়, বরং অনেক বেশি মানবিক। নিবেদিতা লিখছেন: “ভারতীয় জীবনে
ভিক্ষুকের সামাজিক তাৎপর্যের মতো আকর্ষণীয় বিষয় খুব কমই আছে। কান্ট
এবং স্পিনোজার জীবনে সম্পদের প্রতি যে বিতৃষ্ণা দেখি তা ভারতীয় পরিবেশে
সহজেই যথার্থ ত্যাগে পর্যবসিত হয়। এখানে গৃহ ও আচ্ছাদনের প্রয়োজন খুব
সামান্য—একমুঠো চাল যে-কোন বাড়িতে পাওয়া যায় এবং কিছু শাকপাতাই শুধু
দরকার। কিন্তু ভিক্ষুকের ওপরে সবাই দায়িত্ব দিয়েছে তার পৃষ্ঠপোষকদের সঙ্গে
মত-বিনিময় ও মহৎ চিন্তার। সুতরাং সে উঠানে দাঁড়িয়ে গান গেয়ে বা মন্ত্র পড়ে
নিজের উপস্থিতি জানায়। অর্থাৎ সে সর্বদা ভগবানের নাম করতে করতে আসে।
এদের গান নিয়ে গোটা সাহিত্যই আছে।... ইউরোপে আমরা যাকে বলি ‘কেল্টিক
ভাব’, এগুলো তাতে পূর্ণ। সুতরাং খুব সাধারণভাবে বলতে গেলে ভারতীয় ভিক্ষুক
স্বদেশের লোককাব্যের সংরক্ষক।... আবার যে-স্ত্রীলোক তাকে ভিক্ষা দেয়, সে তার
ধর্মশিক্ষকও। যে-সব বিষয়ে স্ত্রীলোকটি অপর কাউকে কিছু বলার সুযোগ পায় না,
সে-সব বিষয়ে ভিক্ষুক আলোচনা করে এবং এইভাবে সংস্কৃতিকে দূর-দূরান্তরে ছড়িয়ে
দেয়।” অর্থাৎ নিবেদিতার কাছে এই ভিখারি শ্রেণি ছিল চলমান সংস্কৃতির বাহক।
কিন্তু এই ভিখারিদের মধ্যেও থাকে গোঁড়ামি, তারা নিজের গণ্ডি বা জাতি সম্বন্ধে
সচেতন। নিবেদিতা উল্লেখ করেছেন, একবার একটি পাউরুটি কিনে ভিখারিকে
দিতে গেলে সেই ভিখারি তা নিতে অস্বীকার করে। কারণ, খামি দিয়ে পাউরুটি
প্রস্তুত করেছে কোন মুসলমান আর তা প্রদত্ত হচ্ছে নিবেদিতার হাত দিয়ে। সুতরাং
তা খ্রিস্টানের ছোঁয়া। বিধর্মীর স্পর্শদোষে দুষ্ট খাদ্যকে কোন ভিখারিও গ্রহণ করতে
নারাজ। তবে এ যদি রুটি না হয়ে কিছু পয়সা হতো, তবে সে আনন্দের সঙ্গে
গ্রহণ করত। এই মানসিকতা দেখে নিবেদিতা অবাক হয়েছেন। জাতিব্যবস্থার মধ্যে
বা সামাজিক স্তরবিন্যাসের মধ্যে অন্ন গ্রহণ ও প্রদানের যে-রীতিনীতি আছে তা
ধনহীন ভিক্ষুকও নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে। যদিও এই ঘটনা নিবেদিতাকে আহত
করেছিল। তাঁর ধারণা ছিল বিদেশে ভিখারিদের পয়সা দিলে তারা মদ কিনে খায়,
তাই দান হিসাবে কিছু খাদ্যদানই শ্রেয়। কিন্তু ভারতে এসে সেই ধারণা নিবেদিতার
ভেঙে যায়। বর্তমানে আমরা জাতিব্যবস্থার কাঠামোকে যেহেতু কঠোরভাবে পালন
করি না, তাই এখন অর্থের পরিবর্তে খাদ্যদানকেই উৎকৃষ্ট বলে কোন কোন ক্ষেত্রে
স্বীকার করা হয়। কিন্তু নিবেদিতার সময় পরিস্থিতি ছিল ভিন্ন।
(পৃষ্ঠা - ৩৭৯ - ৩৮০)