( ভগিনী নিবেদিতা ও জগদীশচন্দ্র বসু )
(প্রব্রাজিকা অমলপ্রাণা,, সাধারণ সম্পাদক,, শ্রী সারদা মঠ,, দক্ষিণেশ্বর)
ভারত-ভগিনী নিবেদিতা ছিলেন ভারতের একান্ত প্রেমিকা ও সেবিকা
একাধারে। এই সময়কার অপর একজন বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব – বিজ্ঞানজগতে যিনি
ভারতকে শীর্ষস্থানে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করেছিলেন, তিনি ভারতের
অন্যতম শ্রেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক জগদীশচন্দ্র বসু। এই দুই বিরাট ব্যক্তিত্বের কর্মক্ষেত্র পৃথক
হলেও তাঁদের কর্মভূমি ভারতবর্ষ এবং সুগভীর ভারতপ্রেমের সাধারণ সূত্র ধরে
এঁদের পরস্পরের মধ্যে যে গভীর সম্পর্ক গড়ে উঠবে তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই।
স্বামী বিবেকানন্দের মানসকন্যা ভগিনী নিবেদিতা স্বামীজীর সান্নিধ্যে এসে
ভারতকে অত্যন্ত আন্তরিকভাবে ভালবেসে ফেলেছিলেন এবং তাঁর গুরুদত্ত
নামটিকে প্রকৃত অর্থে সার্থক করে তুলেছিলেন। তাঁর অবদান শুধু ভারতের
স্বাধীনতা আন্দোলনেই নয়; জাতির সর্বাঙ্গীণ উন্নতির প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই, যেমন—
সাহিত্য, বিজ্ঞান, শিল্পকলা, স্থাপত্য, ভাস্কর্য ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রেই তাঁর অবদান
ছিল অপরিসীম।
জগদীশচন্দ্রের জন্ম হয়েছিল তখনকার দিনের অবিভক্ত বাংলার
ময়মনসিংহে। তাঁর পিতা ভগবানচন্দ্র বসু
ছিলেন সেখানকার ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট।
মায়ের নাম বামাসুন্দরী দেবী। তাঁর জন্ম
হয়েছিল ৩০ নভেম্বর, ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে।
আদর্শবাদী, দেশপ্রেমিক পিতা তাঁর
সন্তানকে ইংরেজী স্কুলে পড়তে না
দিয়ে তাঁরই প্রতিষ্ঠিত বাংলা বিদ্যালয়ে
পড়িয়েছিলেন। এর ফলে জগদীশচন্দ্র
লাভ করেছিলেন স্বদেশ ও স্বজাতির
ঐতিহ্যকে। বহু পরে তিনি বলেছিলেন:
“আজ বুঝতে পারছি, কি উদ্দেশে বাংলা
স্কুলে বাবা আমাকে ভর্তি করে দেন।
সেখানে শুরুতে মাতৃভাষায় শিক্ষা নিতে
হয়েছে, সেই ভাষায় ভাবতে হয়েছে,
জাতীয় ভাষার মধ্য দিয়ে জাতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় ঘটেছে, আমি নিজেকে
জনগণের একজন বলে ভাবতে শিখেছি, উচ্চম্মন্যতা আমাকে সরিয়ে রাখেনি।
স্বদেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি, প্রকৃতি ছেলেবেলায় তাঁর মনে গভীর রেখাপাত
করেছিল। এগারো বছর বয়সে জগদীশচন্দ্র মফস্বল থেকে কলকাতা শহরে এসে
প্রথমে হেয়ার স্কুলে, পরে সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলে ভর্তি হন। তারপর বৃত্তি নিয়ে
এন্ট্রান্স পরীক্ষা পাশ করে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজেই বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা আরম্ভ
করেন। সেখান থেকেই বিজ্ঞান নিয়ে আই.এ. এবং পরে বি.এ. পাশ করেন। এরই
সঙ্গে সংস্কৃত এবং ল্যাটিনও তিনি ভালভাবে শিখেছিলেন। তারপর পিতার আর্থিক
সঙ্কট দূর করার জন্য বিদেশে গিয়ে আই.সি.এস. পড়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। তাঁর
পিতার মহত্ত্ব এখানেই প্রকাশিত হয়েছিল যে, তিনি কিন্তু তাঁর পুত্রকে প্রশাসক হতে
না দিয়ে বিদ্বান হওয়ার অনুপ্রেরণা দিয়েছিলেন। তাই বিজ্ঞানে উচ্চশিক্ষার জন্য
তিনি জগদীশচন্দ্রকে ইংল্যান্ডে পাঠান। পারিবারিক অর্থসঙ্কট সত্ত্বেও পিতার এই
চরম নির্দেশ পেয়ে তার মনে হয়েছিল : “আমি জানলাম, আমি অপরের শাসক হব
না, আমি শাসন করব শুধু নিজেকে; বিদ্বান হতে হবে আমাকে, প্রশাসক নয়।””
তিনি ইংল্যান্ডে সম্মানের সঙ্গে শিক্ষা সমাপ্ত করে একসঙ্গে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়
এবং লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞানে অত্যুচ্চ ডিগ্রী নিয়ে যখন দেশে ফিরলেন,
তখন ভারতে ভাইসরয় ছিলেন উদারনৈতিক লর্ড রিপন। জগদীশচন্দ্র লন্ডনের
অর্থনীতির অধ্যাপক ফসেটের সুপারিশপত্র নিয়ে এসেছিলেন বলে সঙ্গে সঙ্গে লর্ড
রিপন তাঁকে উপযুক্ত চাকরি দেওয়ার জন্য ডি. পি. আই.-কে লিখে পাঠালেন। কিন্তু
ডি. পি. আই. নেটিভ বলে তাঁকে ইম্পিরিয়াল সার্ভিসে চাকরি দিতে একেবারেই
রাজি ছিলেন না। কিন্তু তাঁর কথামতো জগদীশচন্দ্র প্রভিন্সিয়াল এডুকেশন সার্ভিসে
যোগদান করতে অস্বীকার করেন। এর ফলে তখন থেকে তাঁকে জীবনে প্রতি পদে
লড়াই করে এগতে হয়েছিল। তিনি প্রথম থেকেই দৃঢ়সঙ্কল্প নিয়েছিলেন যে, প্রথমত,
চাকরির ক্ষেত্রে ইংরেজ ও ভারতীয়দের মধ্যে বেতনের দিক দিয়ে যে বৈষম্য তা
দূর করবেনই এবং দ্বিতীয়ত, তিনি দেখাবেন—ভারতীয়রাও বিজ্ঞানশিক্ষা দিতে
পারে—শুধু তাই নয়, বৈজ্ঞানিকও হতে পারে। পরে ডি.পি.আই. বাধ্য হয়ে
তাঁকে অস্থায়িভাবে ইম্পিরিয়াল সার্ভিসে চাকরি দেন। কিন্তু ব্রিটিশদের তুলনায়
তাঁর মাহিনা ছিল এক-তৃতীয়াংশ কম। নেটিভ এবং ব্রিটিশদের মধ্যে বেতনের
এই বৈষম্যের প্রতিবাদকল্পে তিনি প্রায় তিন বছর বেতন গ্রহণ করেননি, যদিও
সে-সময় তাঁর আর্থিক অবস্থা ছিল অত্যন্ত শোচনীয়। তবে তিন বছর চাকরির পর
তিনি শেষপর্যন্ত সংগ্রামে জয়ী হয়ে একসঙ্গে তাঁর প্রাপ্য সবটুকু বেতনই পেয়েছিলেন
এবং তাঁর চাকরিও স্থায়ী হয়েছিল।