*রামকৃষ্ণ ও তাঁর শিষ্যগণ - ক্রিস্টোফার ইশারউড,, অনুবাদ - রবিশেখর সেনগুপ্ত*
(৪র্থ পর্ব)
এসব হলো আজকের কথা। কিন্তু আমার আলোচনার বিষয় ১৮৩৬ সালের কামারপুকুর।, যে বাঞ্ছিত বছরটিতে রামকৃষ্ণ জন্মালেন ।সেই সময় অর্থাৎ ১৮৩৬ কামারপুকুর ঠিক কয়েক বিষয়ে অন্তত আজকের চেয়ে সেদিনের কামারপুকুর অনেক উন্নত ছিল। জনসংখ্যা
বাড়লেও খাদ্য ছিল পর্যাপ্ত ; গোলায়-গোলায় ধান ছিল, তাই গ্রামের মানুষ খেয়ে-পরে
বাঁচতো। শেষ যে মহামারী হয় তার ষাট বছর পেরিয়ে গেছে। এই মহামারীতেই বাংলা-
দেশের জনসংখ্যার একতৃতীয়াংশ মানুষ সেদিন নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। সাধারণভাবে স্বাস্থ্যবান
হলেও ১৮৬৭ সালের ম্যালেরিয়া মহামারীর পর থেকেই গ্রামবাসীদের ব্যাপক স্বাস্থ্যহানি
ঘটতে থাকে ।
চাষের কাজ ছাড়াও ছোট-ছোট হাতের কাজ, যেমন মিষ্টান্ন পাক, আবলুস কাঠের হুঁকার
নল তৈরির কাজ, এসবও জানতো। ঘরে-ঘরে তাঁত ছিল। সেখানে হাতে-বোনা ধুতি
গামছা বিক্রির জন্যে চালান যেতো সুদূর কলকাতায় । গ্রামের গা ঘেঁষে একটা রাস্তা
চলে গেছে পুরী জগন্নাথধাম পর্যন্ত। রেল যোগাযোগের আগে কলকাতা থেকে জগন্নাথধাম
যাবার এটিই ছিল একমাত্র সড়কপথ । এই পথের তীর্থযাত্রী ভক্তেরাই সেদিন কামারপুকুর
বাজারের সম্ভাব্য ক্রেতা ছিল ।
শুধু, গোলায়-গোলায় ধান নয় গ্রামের মানুষের গলায়-গলায় গানও ছিল ; মোটামুটি
সুখী ছিল তাদের জীবন। দারিদ্র্য ছিল, তবে এই আপেক্ষিক দুষ্ট ব্যাধির দায় সমাজের
সব শ্রেণীর মানুষ ভাগ করে নিয়েছিল। ফলে সকলের মিলিত সাহায্যে দারিদ্র্য বহু-
ব্যাপক হয়ে উঠতে পারে নি । এইভাবে কামারপুকুরের সমাজ আধুনিক সমাজবিজ্ঞানের
এক গুরুত্বপূর্ণ চাহিদা মিটিয়েছিল। জাতি কাঠামোয় স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের
একটা নির্দিষ্ট ঠাঁই ছিল । কেউ অবহেলিত বোধ করে নি। দূর হ'ক নিকট হ’ক, সব
আত্মীয়ই গোটা পরিবারের অন্তর্ভুক্ত ছিল। বয়োজ্যেষ্ঠরা গণ্যমান্য ছিলেন । মহিলারা
ছিলেন সম্মানিত। শিশুরা ছিল সকলের কাছেই সমান আদরণীয়। ব্যক্তিত্ব বিচারের
সময় আমরা রামকৃষ্ণের মধ্যেও সরল নিষ্পাপ গ্রাম্য শিশু ভাবের এক পরমানন্দ প্রকাশ
পরবর্তীকালে দেখবো। অপার মাতৃস্নেহ-নির্ভর এই শিশু, তার জীবনের শুরু থেকেই
নিশ্চিতভাবে সকলের ভালবাসা পেয়ে এসেছে। বাল্যাবস্থা থেকে কোনো ব্যর্থতার গ্লানিই
তাঁকে কখনও স্পর্শ করে নি। তাই কোনো পরম্পর বিরোধিতা কিংবা অসুস্থ মানসিকতার
উদয় তাঁর চরিত্রে কখনও হয় নি । পরবর্তীকালে রামকৃষ্ণের জীবনের মনস্তাত্ত্বিক দিকের
আলোচনার সময় আমাদের এই কথাটি মনে রাখতে হবে ।
*যদি বলি যে, জাতিপ্রথা মেনে নিয়ে সেদিন গ্রামবাসীর অধিকারবোধ সুদৃঢ় হয়েছিল,
তাহলে আমার উক্তি আপনাদের কাছে অসঙ্গতি দোষ-দুষ্ট বলে মনে হতে পারে । কারণ,
জাতিপ্রথা মেনে নেবার অর্থই হলো-শ্রেণীবিশেষকে জাতি-কাঠামোর বাইরে রাখার ঝোঁক।কিন্তু জাতিপ্রথা বর্জনকর প্রথা নয় ; বরং বলা যায়, এ প্রথার উদ্দেশ্য হলো পরস্পরেরপ্রতি নির্ভরশীল থাকা । শ্রমের বিন্যাস, বৃত্তি অনুসারে শ্রেণীর বিভাজন করাই হলো এ প্রথার মূল ভিত্তি। সে যুগে তাই এক জাতি বা বর্ণ অপর জাতি বা বর্ণের সাহায্য
ব্যতিরেকে বেঁচে থাকতে পারতো না* ।
(পৃষ্ঠা ৪ - ৫)
(৪র্থ পর্ব)
এসব হলো আজকের কথা। কিন্তু আমার আলোচনার বিষয় ১৮৩৬ সালের কামারপুকুর।, যে বাঞ্ছিত বছরটিতে রামকৃষ্ণ জন্মালেন ।সেই সময় অর্থাৎ ১৮৩৬ কামারপুকুর ঠিক কয়েক বিষয়ে অন্তত আজকের চেয়ে সেদিনের কামারপুকুর অনেক উন্নত ছিল। জনসংখ্যা
বাড়লেও খাদ্য ছিল পর্যাপ্ত ; গোলায়-গোলায় ধান ছিল, তাই গ্রামের মানুষ খেয়ে-পরে
বাঁচতো। শেষ যে মহামারী হয় তার ষাট বছর পেরিয়ে গেছে। এই মহামারীতেই বাংলা-
দেশের জনসংখ্যার একতৃতীয়াংশ মানুষ সেদিন নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। সাধারণভাবে স্বাস্থ্যবান
হলেও ১৮৬৭ সালের ম্যালেরিয়া মহামারীর পর থেকেই গ্রামবাসীদের ব্যাপক স্বাস্থ্যহানি
ঘটতে থাকে ।
চাষের কাজ ছাড়াও ছোট-ছোট হাতের কাজ, যেমন মিষ্টান্ন পাক, আবলুস কাঠের হুঁকার
নল তৈরির কাজ, এসবও জানতো। ঘরে-ঘরে তাঁত ছিল। সেখানে হাতে-বোনা ধুতি
গামছা বিক্রির জন্যে চালান যেতো সুদূর কলকাতায় । গ্রামের গা ঘেঁষে একটা রাস্তা
চলে গেছে পুরী জগন্নাথধাম পর্যন্ত। রেল যোগাযোগের আগে কলকাতা থেকে জগন্নাথধাম
যাবার এটিই ছিল একমাত্র সড়কপথ । এই পথের তীর্থযাত্রী ভক্তেরাই সেদিন কামারপুকুর
বাজারের সম্ভাব্য ক্রেতা ছিল ।
শুধু, গোলায়-গোলায় ধান নয় গ্রামের মানুষের গলায়-গলায় গানও ছিল ; মোটামুটি
সুখী ছিল তাদের জীবন। দারিদ্র্য ছিল, তবে এই আপেক্ষিক দুষ্ট ব্যাধির দায় সমাজের
সব শ্রেণীর মানুষ ভাগ করে নিয়েছিল। ফলে সকলের মিলিত সাহায্যে দারিদ্র্য বহু-
ব্যাপক হয়ে উঠতে পারে নি । এইভাবে কামারপুকুরের সমাজ আধুনিক সমাজবিজ্ঞানের
এক গুরুত্বপূর্ণ চাহিদা মিটিয়েছিল। জাতি কাঠামোয় স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের
একটা নির্দিষ্ট ঠাঁই ছিল । কেউ অবহেলিত বোধ করে নি। দূর হ'ক নিকট হ’ক, সব
আত্মীয়ই গোটা পরিবারের অন্তর্ভুক্ত ছিল। বয়োজ্যেষ্ঠরা গণ্যমান্য ছিলেন । মহিলারা
ছিলেন সম্মানিত। শিশুরা ছিল সকলের কাছেই সমান আদরণীয়। ব্যক্তিত্ব বিচারের
সময় আমরা রামকৃষ্ণের মধ্যেও সরল নিষ্পাপ গ্রাম্য শিশু ভাবের এক পরমানন্দ প্রকাশ
পরবর্তীকালে দেখবো। অপার মাতৃস্নেহ-নির্ভর এই শিশু, তার জীবনের শুরু থেকেই
নিশ্চিতভাবে সকলের ভালবাসা পেয়ে এসেছে। বাল্যাবস্থা থেকে কোনো ব্যর্থতার গ্লানিই
তাঁকে কখনও স্পর্শ করে নি। তাই কোনো পরম্পর বিরোধিতা কিংবা অসুস্থ মানসিকতার
উদয় তাঁর চরিত্রে কখনও হয় নি । পরবর্তীকালে রামকৃষ্ণের জীবনের মনস্তাত্ত্বিক দিকের
আলোচনার সময় আমাদের এই কথাটি মনে রাখতে হবে ।
*যদি বলি যে, জাতিপ্রথা মেনে নিয়ে সেদিন গ্রামবাসীর অধিকারবোধ সুদৃঢ় হয়েছিল,
তাহলে আমার উক্তি আপনাদের কাছে অসঙ্গতি দোষ-দুষ্ট বলে মনে হতে পারে । কারণ,
জাতিপ্রথা মেনে নেবার অর্থই হলো-শ্রেণীবিশেষকে জাতি-কাঠামোর বাইরে রাখার ঝোঁক।কিন্তু জাতিপ্রথা বর্জনকর প্রথা নয় ; বরং বলা যায়, এ প্রথার উদ্দেশ্য হলো পরস্পরেরপ্রতি নির্ভরশীল থাকা । শ্রমের বিন্যাস, বৃত্তি অনুসারে শ্রেণীর বিভাজন করাই হলো এ প্রথার মূল ভিত্তি। সে যুগে তাই এক জাতি বা বর্ণ অপর জাতি বা বর্ণের সাহায্য
ব্যতিরেকে বেঁচে থাকতে পারতো না* ।
(পৃষ্ঠা ৪ - ৫)